| পঞ্চানন বর্মা (Panchanan Barma) |
পঞ্চানন বার্মা
রায় সাহেব পঞ্চানন বর্মা
ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা
পঞ্চানন সরকার
Panchanan Barma
➽কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহাকুমার খলিসামারি গ্রামে ১২৭২ সালের (ইং-১৮৬৫) এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ঠাকুর পঞ্চানন। কোচবিহার রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন তখন মহারাজ নরেন্দ্র নারায়ণ।
➽ঠাকুরপঞ্চাননের যে সময় আবির্ভাব সেই দশকে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, ব্রজেনশীল। যাঁদের ত্যাগ, কর্ম, সাধনা ও জীবনদর্শনে উদ্ভাসিত হয়েছিল বাংলার আপামর জনগণ। উত্তরবঙ্গের তথা কোচবিহারের সন্তান ঠাকুর পঞ্চাননও ছিলেন এমনই এক ব্যক্তি যিনি তেইশলক্ষ রাজবংশী জাতির মানুষকে ব্রাত্যত্ব থেকে উদ্ধার করে ক্ষত্রিয়ত্বে বরণ করে ঠাকুর পঞ্চানন হয়েছিলেন।
➽শাস্ত্র আলোচনার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছিলেন যে, "রাজবংশী জাতি" "ব্রাত্যক্ষত্রিয়"এবং তারা প্রায়শ্চিত্ত করে উপবীত গ্রহণ করলে পুনরায় ক্ষত্রিয় হবেন। আজও উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জাতির কাছে ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ২৭ শে মাঘ একটি পবিত্র দিন হিসেবে চিহ্নিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত কামরূপ থেকে আগত দেবশর্মা উপাধিধারী ব্রাহ্মণগণ রাজবংশী ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের পৌরোহিত্য করেন।
➽ ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা শুধু সমাজ সংস্কারকই নন, তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ,সংগঠক, জননেতা ও নির্ভীক পুরুষ। মনুষ্যত্বের পূর্ণবিকাশ যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ,এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যে রাজবংশী জাতির মধ্যে প্রথম এম. এ. এল. এল. বি.। শঙ্করপন্থী বৈষ্ণব সাধক দামোদর দেবের সুযোগ্য শিষ্য গোবিন্দ মিশ্রের গীতার পুঁথি আবিষ্কার তাঁর সাহিত্য কর্মের অন্যতম দিক চিহ্ন।১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রংপুরে ওকালতি শুরু করার পরই রংপুরে প্রতিষ্ঠা করেন "উত্তরবঙ্গ সাহিত্য পরিষদ"এবং উত্তরবঙ্গের জাতির জনক রূপে পরিচিত হন। ১৮৯১ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট চার্জ সুপারিনটেনডেন্ট লোক গণনায় রাজবংশী জাতিকে কোচ বলে উল্লেখ করায় তাঁর নেতৃত্বে এক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যার ফলস্বরূপ সাহেবের নির্দেশক্রমে তৎকালীন পন্ডিত সমাজের প্রতিভূ মহামহোপাধ্যায় যাদবেশ্বর তর্করত্ন অভিমত প্রকাশ করেন যে, "কোচ ও রাজবংশী" দুটি আলাদা জাতি।
➽ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাজবংশী ক্ষত্রিয় যুবকদের সৈন্য বিভাগে যোগদানে সহযোগিতা করার জন্য "রায় সাহেব" উপাধি, ও "এম. বি. ই. উপাধি" লাভ করেন। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট আইনজীবী জলপাইগুড়ি নিবাসী উপেন্দ্রনাথ বর্মন কতৃক প্রথম প্রকাশিত হয় ঠাকুর পঞ্চানন জীবনচরিত। উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারক, কৃষক দরদী ও আর্ত মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ, মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক আদর্শ পুরুষ।
➽১৩৭১ সালে রংপুরে ক্ষত্রিয় সমাজ প্রতিষ্ঠা করে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে রাজবংশী কৃষক সমাজকে পুনর্জীবন দান করেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আসামের গৌরীপুর রাজবাড়ীতে অনুষ্ঠিত "উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশনে" খান চৌধুরী আমানত উল্লা আহমেদ, অতুচন্দ্র গুপ্ত, অক্ষয় কুমার মিত্র, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো ইতিহাস প্রেমী পন্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে রংপুর সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে হাজির ছিলেন ঠাকুর পঞ্চানন। এখানেই প্রকাশিত তাঁর "কামতা বিহারী সাহিত্য"নামক প্রবন্ধ। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এই কোচবিহার সাহিত্য সভায় পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপারেও খান চৌধুরী আমানত উল্লা সাহেবের সহযোগী ছিলেন ঠাকুর পঞ্চানন।
➽১৯১৩ সনে ক্ষত্রিয় সমিতির সাধারণ সভায় পঞ্চানন বর্মার প্রস্তাব অনুযায়ী ক্ষত্রিয় ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শিক্ষাজীবন কলকাতা ও কোচবিহারে অতিবাহিত করলেও তাঁর কর্ম জীবন অতিবাহিত হয় রংপুরে। মেধাবী, সমাজসেবী ও মানবদরদি হওয়া সত্ত্বেও কোচবিহার রাজরোষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর তৎকালীন কোচবিহারের রিজিন্সি কাউন্সিল, কোচবিহার সাধারণ ও কার্যানুশাসন বিভাগের এক নোটিশে তাঁকে কোচবিহার ত্যাগ করতে হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত এ রাজ্য থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর অপরাধ ছিল মহারাজা ও মহারানী রিজিন্সি শাসনের প্রতি অসন্তোষের পরিবেশ সৃষ্টি করা। মতান্তরে, নারীর সতীত্ব ও সম্ভ্রমকে এমনই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন যে, এর বিন্দুমাত্র আদর্শ বিচ্যুতি ঘটলে প্রতিবাদ করায় কোচবিহার রাজ্য থেকে তিনি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাসিত হন। এ খবর প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে নভেম্বর কোচবিহার গেজেটে।
➽ঠাকুর পঞ্চানন এর অন্যতম স্মরণীয় কীর্তি রাজবংশী যুবকদের সামরিক শিক্ষার মধ্যে নিজধর্মে প্রতিষ্ঠা করা এবং ক্ষত্রিয় কৃষকদের এই উদ্দেশ্যে তিনি উজ্জীবিত করে বলেন "যুদ্ধ শিক্ষাই ক্ষত্রিয় দের প্রকৃত ও প্রধান শিক্ষা"। ক্ষত্রিয় হয়ে যুদ্ধ না জানা নিন্দনীয় বিষয়। নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি কখনোই পুলিশের উপর নির্ভর না করে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে ধর্ষিতা নারীর উদ্ধারে ব্যবস্থা করেন এবং এরই প্রতিবাদস্বরূপ তিনি প্রতিবাদী কবিতা লেখেন "ডাং ধরি মাও"।
➽১৯৩৩ সালে রাজবংশী জাতিকে তপশিলি শ্রেণীভূক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও রায় সাহেব ঠাকুর পঞ্চাননের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। যদিও ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন হওয়ার পর থেকেই শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে উক্ত সম্প্রদায় সুফল পেতে থাকেন। উত্তরবঙ্গে ও আসামের ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় এই নেতার মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৯৩৫ সনের ৯ই সেপ্টেম্বর (১৩৪২ সালের ২৩শে ভাদ্র)
তথ্য সূত্র-historiciselink.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন