'দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত,শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।'____রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জ্বলন্ত বিগ্রহ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ।তাঁর জীবন দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত। ব্রিটিশরা তাদের সমস্ত শক্তি একত্রিত করেছিল স্বাধীনতার এই অনির্বাণ দীপশিখাটি নিভে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে তার উদাত্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল সুদূর বার্লিনে,সিঙ্গাপুরে, ইম্ফলে।
নেতাজির জন্ম 1897 সালের 23শে জানুয়ারি।উড়িষ্যার কটক শহরে। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত উকিল জানকীনাথ বসু এবং মাতা প্রভাবতী দেবী। সুভাষচন্দ্র বসুর শিক্ষার শুরু হয়েছিল উড়িষ্যার কটক শহরের এক মিশনারি স্কুলে তারপরে রভেন্স কলেজিয়েট স্কুল তারও পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ। তিনি অধ্যাপক ওটেন সাহেবের ভারতীয়দের প্রতি অপমানকর উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন তার পরিনামে তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে তিনি দর্শনে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় পাস করে এম এ পড়তে থাকেন কিন্তু পরীক্ষার পূর্বে লন্ডন যাত্রা করেন। সেখানে 1920 সালে আইসিএস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করে দেশে ফিরে আসেন। সরকারি চাকরির প্রলোভন ত্যাগ করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ সহকারি রূপে ঝাঁপিয়ে পড়েন ভারতের মুক্তিসংগ্রামে। শুরু হয় ভারতের মুক্তি সংগ্রামের এক গৌরবময় ইতিহাস।
সুভাষচন্দ্র বসুর কর্মজীবন ঘটনাবহুল ও রোমাঞ্চকর। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নির্দেশে তিনি হয়েছিলেন জাতীয় শিক্ষালয়ের এর অধ্যক্ষ এবং কংগ্রেসের প্রচার সচিব। এরপর ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারতে আগমন উপলক্ষে পূর্ণ হরতালের আহবায়করূপে গ্রেফতার করা হয় তাকে। কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি হন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক ও ফরওয়ার্ড পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু সরকারবিরোধী বক্তৃতার জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়।
শুধু একবারই নয় জীবনের অধিকাংশ সময়ই তাঁকে কাটাতে হয়েছে বিদেশির কারাগারের অন্তরালে।
দীর্ঘ কারাবাসের কারণে তাঁর দ্রুত স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং চিকিৎসার জন্য তাঁকে ইউরোপ যাত্রা করতে হয় কিন্তু দেশে ফেরার সাথে সাথেই আবার তাঁকে গৃহে অন্তরীণ করা হয়। মুক্তি লাভের পর 1938 সালে হরিপুরা কংগ্রেসের এবং 1939 সালে কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। একশ্রেণীর কংগ্রেসিদের অসহযোগিতা পূর্ণ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
এদিকে সারা পৃথিবীতে তখন জ্বলে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল। সুভাষচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে অগ্রসর হলেন। কিন্তু 1940 সালে তাকে আবার গ্রেফতার করা হলো। ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য নিজের গৃহে অন্তরীণ করা হলো তাকে। 1941 সালের 26 শে জানুয়ারি সংবাদ রটলো সুভাষচন্দ্র নিরুদ্দেশ। অন্যদিকে জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে দেশের মুক্তি সাধনায় এগিয়ে চলেছেন তিনি কাবুল থেকে বার্লিন সেখান থেকে সিঙ্গাপুর। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অনুরোধে সুভাষচন্দ্র হলেন তার গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক -ভারতের প্রিয় নেতাজী ।
'তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব'-- আহ্বান জানালেন নেতাজি ।সঙ্গে সঙ্গে অকাতরে প্রাণ দেবার জন্য দেখা দিল প্রবল উন্মাদনা। 1944 সালে তার আজাদ হিন্দ সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করল সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে। 1945 সালের 15 ই মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের মাটিতে উড়িয়ে দিল ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা। সুভাষচন্দ্র ডাক দিলেন 'দিল্লি চলো'। শুরু হলো দিল্লি অভিযান কিন্তু কালক্রমে ইংরেজ বাহিনীর সাফল্যে ও জাপানের ব্যর্থতায় ,প্রকৃতির বিমুখতায় ও বিভ্রান্ত স্বদেশবাসীর নিষ্ক্রিয়তায় আজাদ হিন্দ সরকারের পতন হলো। দুঃসহ পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নেতাজি নতুন পথের সন্ধানে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সংবাদে প্রকাশ তিনি নাকি তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নিহত। দিনটা হল 18 ই আগস্ট 1945.
দেশবাসী তার মৃত্যু সংবাদ বিশ্বাস করেনি,আজও করে না ।তার এই মৃত্যু সম্পর্কিত রহস্যময় ও অসঙ্গতিপূর্ণ বিমান দুর্ঘটনার কাহিনী তাদের কাছে এক মিথ্যা অপপ্রচার ,এক গভীর চক্রান্ত। তাই বরণ ডালা সাজিয়ে আজও বাঙালি তথা সমগ্র ভারতবাসী তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রতীক্ষায় থাকে।
স্বাধীনতা লাভের পর 75 বছর কেটে গেছে।দেশের মাটিতে সংঘটিত হয়েছে একাধিক দাঙ্গা, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ।দেশের ক্ষমতা দখল করেছে একশ্রেণীর স্বার্থ সর্বস্ব রাজনীতিকরা। আজ কোথায় গেল নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের জ্বলন্ত দেশপ্রেমের সেই মহান মন্ত্র 'Give me blood and I promise you freedom'.
স্বাধীনতা লাভের পর ভারত-শাসন নেতাজির মত সৎ, দক্ষ,প্রকৃত দেশপ্রেমিক, জনগনমন-অধিনায়ক এর হাতে সমর্পিত হলে ভারতের এই দুর্গতি ও দুর্ভাগ্যের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণের চিত্র আমাদের দেখতে হতো না।
নেতাজির আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা আজ প্রতিনিয়ত স্বদেশের সঙ্গে করে চলেছি বিশ্বাসঘাতকতা। নেতাজির জন্মের 125 বছর অতিক্রান্ত । তাঁর স্বপ্ন ও কর্মসাধনা ভারতপ্রেম ও ভারত পরিকল্পনার যথার্থ মূল্যায়ন ও মর্মোদ্ধার প্রয়োজন।
1945 সালের পর 77 বছর পেরিয়েছে। এত বছরে নেতাজির প্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন ঘটেনি। জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে তার নাম, তার নামের গুণকীর্তনের বদলে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নতুন করে নেতাজির সম্মানে দিল্লিতে ইন্ডিয়া গেটে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি বসানোর ঘোষণা করেছে।
আজ আর এক তেইশে জানুয়ারি।আজকের দিনে সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নেতৃত্তের বড়ই প্রয়োজন। দেশপ্রেমের আবেগ এখন যেন বড়ই ফিকে। 23 শে জানুয়ারি, 26 শে জানুয়ারি, 15 ই আগস্ট পালনের যে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ তা আজ আর দেখা যায় না। ছাত্র-ছাত্রী তথা শিক্ষার্থীদের মনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরতে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সমাজের সচেতন মানুষ কে ভূমিকা নিতে হবে।
(তথ্যসূত্র: প্রবন্ধ বিচিত্রা, পি.আচার্য)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন